অস্পৃশ্যতা (জাতিভেদ প্রথা)
অস্পৃশ্যতা হল হিন্দু সমাজে প্রচলিত একটি প্রথা, যেখানে কিছু মানুষকে সমাজের "অস্পৃশ্য" বা "অন্ত্যজ" হিসেবে গণ্য করা হতো এবং উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গে তাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও দৈনন্দিন জীবনের মেলামেশায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এটি জাতিভেদ প্রথার (Caste System) একটি কঠোর রূপ, যা মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত।
---
অস্পৃশ্যতার উৎপত্তি ও কারণ
বর্ণপ্রথা: হিন্দু সমাজকে চারটি প্রধান বর্ণে ভাগ করা হয়েছিল— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
শূদ্রদের নিচে ‘অস্পৃশ্য’ বা ‘অন্ত্যজ’ শ্রেণি: যাদেরকে সমাজের মূলধারার বাইরে রাখা হতো এবং সমাজের নিম্নতম কাজ (যেমন— চামড়ার কাজ, মৃতদেহ সৎকার, ময়লা পরিষ্কার) করতে বাধ্য করা হতো।
ধর্মীয় কারণ: কিছু ধর্মীয় শাস্ত্রে (যেমন— মনুসংহিতা) বলা হয়েছিল যে, অস্পৃশ্যদের সঙ্গে মিশলে বা তাদের স্পর্শ করলে উচ্চবর্ণের মানুষ "অপবিত্র" হয়ে যাবে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: উচ্চবর্ণের মানুষেরা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিম্নবর্ণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যাতে তারা কখনও সামাজিক উন্নতি করতে না পারে।
---
অস্পৃশ্যতার নিয়মাবলী
অস্পৃশ্য মানুষদের ওপর নানা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, যেমন—
1. মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ – তারা মন্দিরে যেতে পারত না বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারত না।
2. পানি ও কূপ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা – তারা উচ্চবর্ণের মানুষদের কূপ থেকে পানি নিতে পারত না।
3. শিক্ষা ও উন্নতির সুযোগের অভাব – অস্পৃশ্যদের জন্য শিক্ষার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত বা একেবারেই নিষিদ্ধ।
4. উচ্চবর্ণের সঙ্গে মেলামেশার নিষেধাজ্ঞা – তারা উচ্চবর্ণের গ্রামে প্রবেশ করতে পারত না বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারত না।
5. আলাদা বসবাস – অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক বসবাসের এলাকা নির্ধারিত ছিল।
---
অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বিলোপ
১. সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টা
মহাত্মা গান্ধী – তিনি "অস্পৃশ্য" শব্দের পরিবর্তে "হরিজন" (ভগবানের সন্তান) শব্দটি ব্যবহার করেন এবং অস্পৃশ্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
ড. বি.আর. আম্বেদকর – তিনি নিজেই একসময় "অস্পৃশ্য" ছিলেন এবং তিনি জাতিভেদ প্রথা বিলোপ ও দলিত সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
২. আইন ও সংবিধান
১৯৪৯ সালে ভারতের সংবিধান জাতিভেদ প্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে।
১৯৫৫ সালের অস্পৃশ্যতা বিলোপ আইন – এই আইনের মাধ্যমে অস্পৃশ্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
---
বর্তমান অবস্থা
শহরাঞ্চলে জাতিভেদ প্রথার প্রভাব কমে এলেও, ভারতের গ্রামাঞ্চলে এখনো কিছু জায়গায় দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।
ভারত সরকার দলিতদের উন্নয়নের জন্য সংরক্ষিত কোটা (Reservation System) চালু করেছে, যা তাদের শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে সুযোগ দেয়।
---
উপসংহার
অস্পৃশ্যতা ছিল একসময় হিন্দু সমাজের বড় একটি সামাজিক সমস্যা, যা মানুষকে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করত। যদিও আইনি ও সামাজিকভাবে এটি বিলুপ্ত করা হয়েছে, তবুও এর প্রভাব কিছু ক্ষেত্রে রয়ে গেছে। শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে এই বৈষম্য আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।
0 Comments