কৌলীন্য প্রথা: এক সামাজিক কুপ্রথা
কৌলীন্য প্রথা হল হিন্দু সমাজে প্রচলিত একটি প্রথা, যেখানে উচ্চবর্ণের (বিশেষত ব্রাহ্মণ) পুরুষদের মধ্যে একাধিক বিবাহ করার প্রচলন ছিল। এই প্রথা সমাজে নারীদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ ও অবিচার তৈরি করেছিল।
---
কৌলীন্য প্রথার উৎপত্তি ও কারণ
এটি মূলত ১১-১২ শতকে বাংলার সেন রাজবংশের সময় শুরু হয়।
উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের "শুদ্ধতা" বজায় রাখার জন্য একজন ব্রাহ্মণ পুরুষ অনেক নিম্নবয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে পারত, কিন্তু স্ত্রীদেরকে স্বামীসেবা ছাড়া অন্য কোনো অধিকার দেওয়া হতো না।
ব্রাহ্মণদের উচ্চ কৌলীন্য বজায় রাখার জন্য তাদের বেশি বিয়ের অনুমতি দেওয়া হতো, যা পরে বাণিজ্যিক রূপ নেয়—অর্থাৎ, ধনী পরিবার থেকে মোটা অর্থ বা যৌতুক নিয়ে বিবাহ করা হতো।
---
কৌলীন্য প্রথার নিয়মাবলী
1. একজন ব্রাহ্মণ পুরুষ বহু নারীর স্বামী হতে পারতেন, কিন্তু নারীদের একাধিক বিবাহের অধিকার ছিল না।
2. অল্প বয়সে বিবাহ: মেয়েদের খুব কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো, কারণ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পুরুষরা "বিশুদ্ধ" স্ত্রী চাইত।
3. অবহেলা ও বিধবা সমস্যা: অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ স্বামীরা একাধিক স্ত্রীকে অবহেলা করত, ফলে অনেক নারী অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে পড়ত।
4. ব্রাহ্মণদের জন্য অর্থ উপার্জনের মাধ্যম: কিছু উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ পরিবারের জন্য এটি ব্যবসায়িক চেহারা নেয়, যেখানে তারা অর্থ বা উপঢৌকন গ্রহণ করে বহু বিবাহ করত।
5. নারীদের প্রতি সামাজিক অবিচার: নারীরা স্বামীর ভালোবাসা বা সম্মান পেত না এবং তাদের শিক্ষার কোনো সুযোগও ছিল না।
---
কৌলীন্য প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বিলোপ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই প্রথার অন্যতম কঠোর বিরোধিতা করেন এবং তিনি বিধবা বিবাহ আইন (১৮৫৬) চালু করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে বহুবিবাহ রোধে আইন প্রণয়ন করা হয়, যা কৌলীন্য প্রথার বিলোপে সাহায্য করে।
১৯৫৫ সালে "হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট" পাশ হওয়ার পর, বহুবিবাহ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
---
উপসংহার
কৌলীন্য প্রথা ছিল এক ধরনের নারী নির্যাতন ও সামাজিক বৈষম্যের প্রতীক, যা নারীদের প্রতি অবিচার ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মজবুত করেছিল। আইন ও সমাজ সংস্কারকদের প্রচেষ্টায় এটি বিলুপ্ত হলেও, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব এখনো কিছু ক্ষেত্রে রয়ে গেছে।
0 Comments