লাঙ্গলবন্দ পূণ্যস্নান এর ইতিহাসI

  



ত্রেতাযুগের প্রথম দিকে মগধদেশে ভাগীরথী, কৌশিকী নদীর তীরে অবস্থিত  ভোজকোট নামক নগরীর অধিপতি ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজর্ষি গাধি। আর এই  রাজর্ষি গাধির বিশ্বামিত্র নামে এক পুত্র ও সত্যবতী নামে এক সুন্দরী কন্যা ছিল। ভৃগু বংশীয় ব্রাহ্মণ কুমার ভৃগুমুনি রিচিকের সাথে বিবাহ হয়  সত্যবতীর । সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক মুনির জন্ম হয়। যখন জমদগ্নি বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন প্রসেনজিৎ রাজার কণ্যা রেণুকাকে বিবাহ করেন। রেণুকার এবং জমদগ্নির ঘরে পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে।আর এই  কনিষ্ঠ সন্তান পরশুরামই ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার।

.

  জন্মলগ্নে এই পুত্রের নাম রাখা হয়েছিলো রাম। ইনি কুঠার দ্বারা একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করেন বলে তাঁর নাম পরশুরাম বা কুঠারধারী রাম রূপে খ্যাত ছিল। ভৃগুবংশের সন্তান, এজন্য তাঁকে ভার্গব এবং জমদগ্নির পুত্র বলে তাকে জমদগ্ন্য নামেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে ।

.

একদিন জমদগ্নির পাঁচপুত্র ফল সংগ্রহার্থে বনে গেলে, তাদের মাতা রেণুকাদেবী স্নানপূর্বক পানীয় জল আনয়নের জন্য নিকটস্থ গঙ্গানদীতে যান। যখন তিনি  নদীর ঘাটে জল আনতে যান, তখন তিনি দেখতে পান গঙ্গা নদীতে শতবাহু নামে এক রাজা তাঁর শতস্ত্রী সঙ্গে জলকেলি করছিল।

.

 এমত জলকেলি চলাকালে দেবী রেণুকা নদীর ঘাটে গিয়ে শতবাহু রাজার কৌতকপূর্ণ নয়নাভিরাম জলকেলি দর্শনে অন্তরে এক বিচিত্র পুলক অনুভব করলেন ।কিছুক্ষণ এ দৃশ্য দেখার পর জল নিয়ে ঘরে ফিরলে ঋষি জমদগ্নি স্ত্রীর বিলম্ব ও শরীর রোমাঞ্চিত হবার কারণ ঋষি জমদগ্নি  জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু রেণুকাদেবীকে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি যোগবলে পূর্বাপর সকল ঘটনা অবগত হন। ঋষি স্ত্রীর এ ধরণের  মানসিক বিকৃতিতে ক্রোধাম্বিত হয়ে পড়েন ঋষি জমদগ্নি। রূঢ়স্বরে তৎক্ষণাৎ সকল পুত্রদেরকে তাদের মাতাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ চার পুত্রই মাতাকে হত্যা করতে অস্বীকার করেন এবং তারা তাঁদের পিতার আদেশ অমান্য করেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে চার পুত্রকেই  অভিশাপ দেন যেনও পশু-পক্ষীর মতো জড় ও হীনবুদ্ধি সম্পন্ন নিকৃষ্ট জীবন প্রাপ্তির হয় । সর্বশেষ ঋষি জমদগ্নি তাঁর পঞ্চম পুত্র রামকে মাতৃহত্যার আদেশ দেন। বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার মহামুনি ভৃগুর প্রপৌত্র পরশুরাম, জমদগ্নি পুত্র কম্পিত হৃদয়ে শঙ্কিত চিত্তে পিতৃ আজ্ঞা সম্পন্ন করেন।

.


.

পিতৃআজ্ঞা পালন করার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ জমিদগ্নি ঋষি পরশুরামকে বর চাইতে বললেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হৃদয় নিয়ে পরশুরাম আবেগ আল্পুত কণ্ঠে বর চাইলেন,

.

(১) তপঃপ্রভাবে আমাদের মা যেনো আবার জীবিত হয়ে যান   এবং আমাদের সাথে বসবাস করেন।

(২) হত্যার ঘটনা মায়ের স্মরণে না থাকে।

(৩) জ্যেষ্ঠভ্রাতাগণ মনুষ্যবৎ জীবন ফিরে পান।

(৪) এই হতাকান্ডে যেনো আমার পাপস্পর্শ না হয়।

.

কিন্তু যেই মাত্র মাতার দেহ কুঠারে দ্বিখন্ডিত হয়েছিল ঠিক সেই মুহুর্তেই পরশুরাম মাতৃহত্যা ও নারী হত্যাজনিত পাপে আক্রান্ত হলেন। কিন্তু তাঁর হাতের কুঠার সেই হাতেই লেগে আছে। তিনি উদ্বিগ্নাকুল চিত্তে পিতৃদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, "পিতা! আমি তো আজ্ঞাবহ মাত্র ছিলাম, তবে কেনো কুঠার আমার হাতে লেগে আছে?"

.

  পিতা বললেন, "তুমি মাতৃহত্যা আর নারীহত্যা দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত হয়েছো। তাই জেনে রেখো, পাপ ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেনো, কৃতকর্মীকে তা স্পর্শ করবেই।"

.

 ঋষি পুত্রকে আশ্বস্ত করে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিলেনএবং  উদ্বিগ্ন না হয়ে অবিলম্বে সর্বতীর্থ পরিভ্রমণের উপদেশ দিয়ে বললেন, "যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে, জানবে যে ঐ পুণ্যস্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র। "

.

 পিতৃ আজ্ঞা প্রাপ্ত হয়ে পরশুরাম পৃথিবী পর্যটনে বের হন এবং তিনি নানা তীর্থ পরিভ্রমন করতে লাগলেন। অবশেষে একদিন তিনি হিমালয় পর্বতের উত্তর-পূর্ব কোণে, মানস সরোবরের সন্নিকটে এক বৃহৎ কুপ সমীপে উপনীত হলেন। এবং তিনি পরমেশ্বরকে স্মরণ করে পরশুরাম ব্রহ্মকুন্ডে অবগাহন করলেন। অবগাহন করার সঙ্গে সঙ্গে  তাঁর হাতে লেগে থাকা কুঠারখানা স্খলিত হয়ে গেলো। তিনি সর্ববিধ পাপ থেকে অব্যাহতি পেলেন আর মহাপাপ থেকে মুক্তি লাভ করলেন ।

.

 পরশুরাম মনে মনে স্থির করলেন, এমন সুমহান পুণ্যজল বা সলিল যা আমাকে মহাপাপ থেকে মুক্ত করেছে, সেই পুণ্যজল সর্বসাধারণের নিত্য সহজ লভ্য করার জন্য তিনি  এর ধারা পৃথিবীতে প্রবাহিত করবেন বলে ঠিক করলেন ।

.

.

 তারপর তিনি তার কর্ষণের লাঙ্গল দিয়ে মাটি চষে নিয়ে ক্রমাগত চলতে চলতে ব্রহ্মকুন্ডের জল ধারাকে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে নিয়ে আসেন। ফলে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা অন্তর্গত সোনারগাঁও মহেশ্বরদি পরগণাকে দু’ভাগে বিভক্ত করে ব্রহ্মপুত্রের এই ধারা ধলেশ্বরী নদীতে পতিত হয়।

.

 সুদূর হিমালয় থেকে একাধিক ক্রমে হাল চালনায় ক্লান্ত হয়ে পরশুরাম বিশ্রাম করার জন্য যেখানে কর্ষণের লাঙ্গল বদ্ধ রাখেন এবং এই স্থানের নাম হয় ‘লাঙ্গলবন্দ’।


x

Post a Comment

0 Comments

Close Menu