মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (কবি কঙ্কণ)

 মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (কবি কঙ্কণ): বাংলা কাব্যসাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, যিনি "কবি কঙ্কণ" নামেও পরিচিত, বাংলা মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি মূলত তাঁর রচিত "চণ্ডীমঙ্গল কাব্য" বা "অভয়ামঙ্গল" গ্রন্থের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ হিসেবে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

### জীবনী ও পরিচয়

মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর জন্ম সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, তিনি ১৫শ বা ১৬শ শতকের কবি ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দামানহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, তবে তাঁর কাব্যে সে যুগের সমাজ, সংস্কৃতি ও কৃষিজীবনের প্রতিচিত্র পাওয়া যায়।

"কবি কঙ্কণ" নামটি তিনি নিজেই নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন, যা সম্ভবত তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য মূলত ধর্মীয় ও পৌরাণিক বিষয়কেন্দ্রিক ছিল, এবং মুকুন্দরামও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না

### চণ্ডীমঙ্গল কাব্য: বাংলা মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ রচনা

মুকুন্দরামের প্রধান সাহিত্যকীর্তি হল "চণ্ডীমঙ্গল কাব্য", যা "অভয়ামঙ্গল" নামেও পরিচিত। এটি মঙ্গলকাব্যের ধারায় রচিত একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। মঙ্গলকাব্যগুলি সাধারণত হিন্দু দেবদেবীদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে রচিত হতো এবং সমাজে ধর্মীয় আচার-বিশ্বাস প্রচারের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মূল বিষয়বস্তু:

এই কাব্যে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য এবং তাঁর ভক্তদের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কাব্যের মূলত তিনটি প্রধান অংশ রয়েছে:

1. কালকেতু উপাখ্যান

2. শ্রীরাম উপাখ্যান

3. ধনপতি-ধনঞ্জয় উপাখ্যা

প্রতিটি অংশে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষের কথা তুলে ধরা হয়েছে, যা মুকুন্দরামের সাহিত্যিক প্রতিভার পরিচায়ক।

### চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বিশ্লেষণ

১. কালকেতু উপাখ্যান

এটি মূলত এক দরিদ্র কিন্তু ধার্মিক গৃহস্থ কালকেতু ও তাঁর স্ত্রী ফুল্লরার কাহিনি। কালকেতু ছিল এক সহজ-সরল কৃষক, যার উপর দেবী চণ্ডীর আশীর্বাদ বর্ষিত হয় এবং সে ধনসম্পত্তি লাভ করে। এই কাহিনির মাধ্যমে মুকুন্দরাম বাংলার কৃষিজীবন, দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা তুলে ধরেছেন।

২. শ্রীরাম উপাখ্যান

এই অংশে এক ব্রাহ্মণ শ্রীরামের কথা বলা হয়েছে, যিনি দেবী চণ্ডীর প্রতি ভক্ত ছিলেন এবং দেবীর কৃপায় ধন-সম্পদ ও সুখ লাভ করেন। এটি ধর্মীয় বিশ্বাস ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের একটি প্রতিচিত্র তুলে ধরে।

৩. ধনপতি-ধনঞ্জয় উপাখ্যান

এটি বণিক শ্রেণির প্রতিনিধি ধনপতি ও তাঁর পুত্র ধনঞ্জয়ের গল্প। ধনপতি ছিলেন ধনসম্পদে সমৃদ্ধ এক বণিক, যিনি দেবী চণ্ডীর উপাসনা করতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি দেবীর অভিশাপে বিপদে পড়েন, কিন্তু পরবর্তীতে দেবীর দয়া লাভ করেন। এখানে মুকুন্দরাম তৎকালীন বণিক সম্প্রদায়ের আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় অনুগত্য ও সমাজে তাঁদের অবস্থান চিত্রিত করেছেন।

### মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য

১. বাস্তববাদিতা ও সমাজচিত্র

মুকুন্দরামের রচনায় মধ্যযুগের বাংলার সমাজের বাস্তবচিত্র পাওয়া যায়। তিনি কেবল পৌরাণিক কাহিনি বলেননি, বরং সে সময়ের কৃষক, বণিক, ব্রাহ্মণ, নারী, দরিদ্র শ্রেণি ও রাজন্যবর্গের বাস্তব জীবন তুলে ধরেছেন।

২. ভাষার সরলতা ও লোকজ উপাদান

তাঁর ভাষা ছিল সহজবোধ্য এবং তাতে বাংলার লোকসংস্কৃতি ও কথ্যভাষার প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তাঁর রচনায় প্রচুর প্রবাদ, লোকগান ও আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা সাহিত্যকে জীবন্ত করে তুলেছে।

৩. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা

তাঁর কাব্যে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা ও মানবতাবাদী মূল্যবোধও প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত, দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি ধর্মীয় আচার, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

৪. নারীচরিত্রের শক্তিশালী উপস্থাপনা

মুকুন্দরামের কাব্যে নারীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, ফুল্লরা, ধনপতির স্ত্রী খনা, চণ্ডী দেবী প্রভৃতি নারীচরিত্রগুলি শক্তিশালী এবং সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

### মুকুন্দরামের সাহিত্যকীর্তির প্রভাব

মকুন্দরাম চক্রবর্তীর সাহিত্য শুধু মধ্যযুগেই নয়, বরং পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর রচনা:

বাংলা মঙ্গলকাব্যের উৎকর্ষ সাধন করেছে।

পরবর্তী যুগের কবিদের, বিশেষত ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, রামপ্রসাদ সেন ও অন্যান্য কবিদের অনুপ্রাণিত করেছে।

বাংলার লোকসংস্কৃতি ও পালাগানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।

### কবি কঙ্কণের সাহিত্যিক গুরুত্ব ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা

১. বাংলার গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিচিত্র

মুকুন্দরামের রচনা মধ্যযুগের বাংলার গ্রামীণ সমাজের এক বাস্তব প্রতিফলন। তিনি দরিদ্র কৃষকের সংগ্রাম, ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণ, ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক আচার ইত্যাদি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন, যা আজও গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

২. আধুনিক সাহিত্যচর্চায় প্রভাব

তাঁর সাহিত্য বাংলা লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যের মূল ভিত্তির অংশ। বর্তমান বাংলা নাটক, পালাগান, ও লোকগীতিতে তাঁর সাহিত্যচর্চার গভীর ছাপ পাওয়া যায়।

৩. ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা

যদিও তাঁর কাব্য মূলত হিন্দু ধর্মের দেবদেবীদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে, তবুও এতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায়।

### উপসংহার

মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (কবি কঙ্কণ) বাংলা সাহিত্যের এক অমর কবি। তাঁর "চণ্ডীমঙ্গল কাব্য" শুধু ধর্মীয় মহাকাব্য নয়, এটি বাংলা সমাজ ও সংস্কৃতির এক বাস্তবচিত্র। তাঁর ভাষা, কাব্যের নির্মাণশৈলী ও সমাজচিত্রণ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

আজও তাঁর সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। তাঁর লেখা কেবল এক সময়ের ধর্মীয় কাহিনি নয়, বরং এটি বাংলার মানুষের জীবন, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতিচিত্র। তাই মুকুন্দরাম চক্রবর্তীকে শুধু মঙ্গলকাব্যের কবি নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন হিসেবে গণ্য করা হয়।



Post a Comment

0 Comments

Close Menu