মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলা সাহিত্যের মহাকবি
ভূমিকা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের একজন অসাধারণ প্রতিভাধর কবি ও নাট্যকার। তিনি বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যিক ধারা প্রবর্তন করে এক নবযুগের সূচনা করেন। তাঁর লেখনীতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে এক নতুন ধারা তৈরি হয়, যা বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়েছে।
---
জীবন ও শিক্ষা
শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত এবং মাতার নাম জাহ্নবী দেবী। তাঁর পরিবার ছিল উচ্চবর্ণের কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত।
প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। পরে তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। হিন্দু কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শেক্সপিয়ার, মিল্টন, বায়রন প্রমুখ ইউরোপীয় কবিদের সাহিত্য তাঁর মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে।
---
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ ও ইংল্যান্ড গমন
মধুসূদন ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এবং প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে বিদ্রোহী মানসিকতার। ১৮৪৩ সালে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং ‘মাইকেল’ নাম গ্রহণ করেন, যা তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাঁর পরিবারও তাঁকে পরিত্যাগ করে।
১৮৬২ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান এবং ব্যারিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে আইন অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ফ্রান্সেও কিছুদিন বসবাস করেন।
---
সাহিত্যজীবনের সূচনা
প্রথমদিকের ইংরেজি রচনা
মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ইংরেজি ভাষায় কবিতা রচনার মাধ্যমে। তিনি প্রথমে ইংরেজিতে কাব্য রচনা করলেও পরে উপলব্ধি করেন যে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করাই তার প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বাংলা সাহিত্যে অবদান
বাংলা সাহিত্যে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল অমিত্রাক্ষর ছন্দ (Blank Verse) প্রবর্তন। তিনি বাংলা ভাষাকে কাব্য রচনার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
---
মাইকেল মধুসূদনের প্রধান সাহিত্যকর্ম
(১) মেঘনাদবধ কাব্য
"মেঘনাদবধ কাব্য" (১৮৬১) তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য। রামায়ণের কাহিনিকে তিনি এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। এখানে তিনি রাবণের পুত্র মেঘনাদকে এক মহান বীররূপে দেখিয়েছেন, যা প্রচলিত কাহিনির বিপরীত।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
বাংলা সাহিত্যে প্রথমবারের মতো অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহৃত হয়।
পৌরাণিক কাহিনির নতুন ব্যাখ্যা।
চরিত্রগুলোর গভীর মানবিক চিত্রায়ণ।
(২) তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য
এটি তাঁর আরেকটি মহাকাব্য, যেখানে পৌরাণিক কাহিনির ওপর ভিত্তি করে রচনা করা হয়েছে।
(৩) ব্রজাঙ্গনা কাব্য
এটি বৈষ্ণব ভাবধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ।
(৪) কপালকুণ্ডলা নাটক
এই নাটকটি বাংলার প্রথম ট্র্যাজিক নাটকগুলোর একটি।
(৫) বীরাঙ্গনা কাব্য
এটি এক বিশেষ ধরনের কবিতা, যেখানে মহাকাব্যের নারী চরিত্রদের চিঠির আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।
---
নাট্য সাহিত্য
মধুসূদন বাংলা নাটকের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) – বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক।
পদ্মাবতী (১৮৬০) – এটি ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত।
---
অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন
মধুসূদন বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন, যা বাংলার কাব্য সাহিত্যে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। তাঁর রচিত "মেঘনাদবধ কাব্য" এই ছন্দের প্রথম সফল প্রয়োগ।
অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
1. ছন্দবদ্ধ হলেও এতে সমমাত্রিকতা নেই।
0 Comments